গ্রন্থ সমালোচনাঃ চাঁদের অমাবস্যা

৩৬তম বিসিএস প্রস্তুতি 
বাংলা গ্রন্থ সমালোচনার জন্য কাজে লাগবে
পবন চৌধুরী 
মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস :- চাঁদের অমাবস্যা
রচনা :-সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ।
কাহিনী সংক্ষেপ :-
'চাঁদের অমাবস্যা’ উপন্যাসের নায়ক একজন স্কুলশিক্ষক৷ নাম আরেফ আলী৷ ঔপন্যাসিক তাকে যুবক শিক্ষক বলে বারবার অভিহিত করেছেন৷

যুবক শিক্ষক অতিশয় দরিদ্র৷ চাঁদপারা গ্রামে তার বাড়ি৷ হাতের তালুর মতো একটু জায়গা-জমি আছে তাদের৷ বিধবা মা সংসারে৷ আর কেউ নেই৷ শাক-সবজির জমিটুকু বিক্রি করে উচ্চশিক্ষার অভিলাষ পূরণ করা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি৷
তাই সদ্য প্রতিষ্ঠিত হাইস্কুলে সে চাকরি নিয়েছে৷ স্কুলটি গ্রামে৷ এ গ্রামের জোতদার বড় দরবেশ সাহেব স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন৷ এ বড় বাড়িতেই লজিং মাস্টার হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে যুবক শিক্ষক।
যুবক শিক্ষকের কোনো খরচ নেই, কেননা আশ্রয়দাতাদের বাড়িতে খায়, থাকে৷ বেতন যা পায়, তা পাঠিয়ে দেয় বিধবা মাকে৷
এক গভীর পূর্ণিমা রাতে যুবক মাস্টার বড় বাড়ি সংলগ্ন জঙ্গলের মতো ঘরের পেছনে এক ঝোঁপের পাশে একটি জাম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকে৷ সে বাইরে এসেছিল প্রাকৃতিক কাজ সারার জন্য৷ হঠাত্‍ দেখতে পায় বড় বাড়ির দাদা সাহেবের ছোট ভাই কাদের দরবেশ হেঁটে যাচ্ছে একা একা ভরা জোছনার ভেতর দিয়ে৷ যুবক মাস্টার কৌতূহলী হয়ে ওঠে৷ সে কাদেরকে অনুসরণ করতে থাকে৷ দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে হয় যুবক মাস্টারকে৷ রাতের জোছনা ভরা, রূপালি চাঁদের ঢেউ খেলানো প্রকৃতি_ চষা ক্ষেত, গৃহসত্মের বসতবাড়ি, ভিটেবাড়ি পেরিয়ে কাদের দরবেশ নদীর পাড়ে এক গভীর বাঁশবনের ভেতর চলে যায়৷ এর মধ্যে যুবক মাস্টার কাদেরের সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে তাকে হারিয়ে ফেলে৷ একটা অনতিদীর্ঘ সময় পর সেও হাজির হয় ওই বাঁশবনে৷ দেখতে পায় এক বীভত্‍স দৃশ্য : ‘শীতের উজ্জ্বল জ্যোত্‍স্না রাত, তখনো কুয়াশা নামে নাই৷ বাঁশঝাড়ে তাই অন্ধকারটা তেমন জমজমাট নয়৷ সেখানে আলো-অন্ধকারের মধ্যে যুবক শিক্ষক একটি যুবতী নারীর অর্ধ উলঙ্গ মৃতদেহ দেখতে পায়৷ … পায়ের ওপর একঝলক চাঁদের আলো৷” (চাঁদের অমাবস্যা-পরিচ্ছেদ এক)৷
এই পাশবিক দৃশ্য দেখে তার মতো যুবক শিক্ষের তাবত্‍ অস্তিত্বের মধ্যে প্রলয়- শুরু হয়ে যায়৷ সে হতভম্ভ, বিভ্রানত্ম, বিমূঢ় ও বিপন্ন দশায় উপনীত হয়৷ তার অস্তিত্বের মধ্যে মারাত্মক সংকট দেখা দেয়৷ সে একটা মরণাপন্ন মুমূর্ষু দশায় উপনীত হয়৷ তার শরীর থরথর করে কাঁপতে থাকে৷ সে চষা ক্ষেত বরাবর রুদ্ধশ্বাসে দৌঁড়াতে থাকে৷ এক পর্যায়ে সে ক্ষেতের আইলের পাশে উবু হয়ে পড়ে থাকে৷ তার ভেতর থেকে চিরতরে প্রশান্তি শিশিরের মতো উবে যায়৷ কত কষ্টে পড়ালেখা শিখেছিল, স্কুলে চাকরি পেয়ে তার দারিদ্র্য বিমোচন ঘটেছিল, আশ্রয় পেয়েছিল এই বড় বাড়িতে৷ এরা জোতদার-ভূস্বামী, এরাই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা৷ বেতন পেলে বিধবা মাকে পাঠিয়ে দিত৷ অথচ এ বাড়িরই প্রভাবশালী ব্যক্তি কাদের দরবেশ এই পাশবিক ব্যভিচারের সঙ্গে জড়িত৷
যুবক শিক্ষকের মতো গ্রাম্য-দরিদ্র-নিরীহ মানুষ এমন ভয়ঙ্কর দৃশ্যের সঙ্গে পরিচিত হয়নি৷ বলা হচ্ছে, ”সাপের মুখগহ্বরে ঢুকে ব্যাঙের আওয়াজ যেন হঠাত্‍ থামে বা মস্তক দেহচ্যুত হলে মুখের আওয়াজ যেন অকস্মাৎ স্তব্ধ হয়৷ দেহচ্যুত মাথা এখনো হয়তো আর্তনাদ করছে, কিন্তু তাতে আর শব্দ নাই৷”
অমানবিক উদাহরণ৷ সাপের গ্রাসের সামনে ব্যাঙ যেমন অসহায়, তেমনি ব্যাঙের মতো অসহায়-দরিদ্র, গ্রামের এক মাঝির বন্ধ্যা যুবতী স্ত্রীকে বাঁশঝাড়ে ডেকে এনে কাদের দরবেশ বলাৎকার করে৷ কৌতূহলবশত যুবক শিক্ষক ওখানে উপস্থিত হলে শুকনো বাঁশ পাতার মচমচ শব্দ শুনে বন্ধ্যা বউটি ভয়ে দাপাদাপি করেছিল, হয়তো চিৎকার দিতে চেয়েছিল, হয়তো নিজেকে কাদেরের লোমশ হাত থেকে বাঁচাতে চেয়েছিল৷ তার কণ্ঠকে স্তব্ধ করার জন্য কাদের শায়িত নারীর গলদেশ চেপে ধরেছিল, তাতে তার মৃত্যু ঘটে৷ অর্ধ বিবস্ত্র অবস্থায় পড়ে থাকে৷ কাদের বাঁশঝাড় থেকে দ্রুত বের হয়ে যায়৷
এখানে কাদের যে বন্ধ্যা বউটিকে ভোগ করার জন্য ডেকে এনেছিল, হয়তো সে স্বেচ্ছায়ই এসেছিল৷ গরিব, এত বড় প্রভাবশালী বড় বাড়ির মানুষের আহ্বান উপেক্ষা করতে পারেনি৷ মানুষের পদশব্দ শ্রবণ করে বিচলিত হয় কাদের৷ কেউ জেনে ফেললে বড় বাড়ির ইজ্জত যাবে৷ তাই বউটির গলা চেপে ধরেছিল, যাতে শব্দ না করে৷ যাতে কেউ না জানে৷ জীবনের চেয়ে ঠুনকো ইজ্জত এখানে বড় হয়ে দেখা দেয় বিবেক, মনুষ্যত্ব লাঞ্ছিত হয়৷
এরই নিদারুণ প্রতিক্রিয়া হয় যুবক শিক্ষকের বিবেকের মধ্যে৷ সবচেয়ে মর্মান্তিক হচ্ছে, তার মধ্যে কাজ করতে থাকে প্রতিকারহীন প্রতিক্রিয়া৷ এটাই অস্ততিত্বের সংকট৷
রাজা ইডিপাস তো জানতেন না যে সে তার বাবাকে হত্যা করবে৷ নিজেরই বিধবা মা জোব্দা স্টাকে বিয়ে করবেন৷ কিন্তু নিয়তির চক্রে এমনই ঘটে গেছে৷ প্রজা দরদি, সত্যসন্ধানী, বিবেকবান রাজা রাষ্ট্র থেকে পাপ বিদূরিত করার জন্য সঠিক ঘটনার আবরণ উন্মোচনে তৎপর৷ থামবেন না তিনি৷ জানালেন লোমহর্ষক হৃদয়বিদারক ঘটনা৷ শুরু হলো দিকচক্রবালব্যাপী মানসিক সংকট৷ যাকে বলে অস্তিত্বের সংকট৷
‘চাঁদের অমাবস্যা’তেও দেখি, অপাপবিদ্ধ যুবক শিক্ষক জানতে পারল, এমন হৃদয়হীন ব্যভিচার কাদের দরবেশই ঘটিয়েছে৷ কিন্তু খুব সহজে কাদেরের ওপর থেকে প্রচলিত ধারণা সরাতে পারছে না৷ সে এমন কাজ করতে পারে!!

Courtesy: Zakir's bcs speical

No comments:

Post a Comment

Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...