৩৬তম বিসিএস লিখিত প্রস্তুতি

.বাংলাদেশ বিষয়াবলী
Md Mohsin
১. স্থানীয় সরকার 
২. স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন
৩. স্থানীয় শাসন ও স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের মধ্যে পার্থক্য 
৪. স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের গুরুত্ব 
৫. বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার বিবর্তন 
..

তৃণমূল পর্যায়ে গণতন্ত্র চর্চা ও বিকাশে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা এক অপরিহার্য উপাদান। পৃথিবীতে এমন খুব কম দেশই রয়েছে যেখানে গণতন্ত্র সুসংহত অথচ শক্তিশালী স্থানীয় সরকার নেই। বাংলাদেশে স্বাধীনতা উত্তরকালে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে বিভিন্ন সময়ে পুন:বিন্যস্ত করা হয়েছে। নিম্নে স্থানীয় সরকার, স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন ও এদের মধ্যে পার্থক্য ও গুরুত্ব সম্পর্কে আলোকপাত করা হলঃ
..
১. স্থানীয় শাসন
স্থানীয় বা Local শব্দটির উদ্ভব হয়েছে Locus শব্দ থেকে যার আভিধানিক অর্থ হলো অঞ্চল । সুতরাং স্থানীয় সরকারের অর্থ হলো অঞ্চল ভিত্তিক সরকার। স্থানীয় সরকার মূলতঃ কেন্দ্রীয় বা প্রাদেশিক সরকারের পক্ষে কোন একটি ক্ষুদ্র এলাকায় সীমিত পরিমাণে দায়িত্ব পালন করে থাকে। জনকল্যাণ মূলক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সরকারের কাজের পরিধি ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় কেন্দ্রীয় বা প্রাদেশিক সরকার তাদের কাজের পরিধি লাঘবের জন্য স্থানীয় সরকারের উপর নানাবিধ কাজের দায়িত্ব অর্পণ করে থাকে। স্থানীয় সরকার কেন্দ্রীয় বা প্রাদেশিক সরকারের পক্ষে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, রাজস্ব আদায় ও সরকারের নীতিসমূহ বাস্তবায়ন করে থাকে। এ ব্যবস্থায় সরকার কর্তৃক নিযুক্ত কর্মকর্তাগণ কেন্দ্রীয় সরকারের অনুদানে স্থানীয় সরকারের উপর অপিত কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে থাকেন ।
..
২. স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন বলতে কোন নির্দিষ্ট এলাকায় জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে পরিচালিত শাসন ব্যবস্থাকে বুঝায়। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা স্থানীয় সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে জনগণের নিকট দায়িত্বশীল থাকে। এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে: 
(ক) আইনগত ভিত্তি, 
(খ) জনপ্রতিনিধিত্বশীল সংস্থা, 
(গ) স্থানীয় এলাকার জন্য উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, 
(ঘ) নিজস্ব তহবিল গঠনের জন্য করারোপের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ, 
(ঙ) স্থানীয় পর্যায়ে বিরোধ নিরসনের জন্য বিচার সংক্রান্ত ক্ষমতা ভোগ, 
(চ) সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশ গ্রহণের সুযোগ । 
স্থানীয় সরকার স্বশাসিত হলেও এটি কেন্দ্রীয় বা প্রাদেশিক সরকারের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণমুক্ত নয়। এটি কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে সরকারের ভেতরে সরকার ।
..
৩. স্থানীয় শাসন ও স্বায়ত্তশাসনের মধ্যে পার্থক্য
স্থানীয় শাসন ও স্বায়ত্তশাসনের মধ্যে পার্থক্য ও স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের মধ্যে বিভাজন না করা হলেও আমাদের এ অঞ্চলে স্থানীয় সরকার ও স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের মধ্যে পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় । উপনিবেশিক শাসনের কারণে স্বায়ত্তশাসন কথাটি বিশেষ অর্থ বহন করে। নিম্নে স্থানীয় সরকার ও স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের মধ্যকার পার্থক্য তুলে ধরা হলো— 
..
প্রথমত, স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের আইনগত ভিত্তি রয়েছে। এর উপর কেন্দ্রীয় বা প্রাদেশিক সরকারের নিয়ন্ত্রণ সীমিত। অপরদিকে কেন্দ্রীয় বা প্রাদেশিক সরকারের প্রশাসনিক কাজের সুবিধার্থে স্থানীয় সরকারের সৃষ্টি, এর উপর কেন্দ্রের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকে। 
....
দ্বিতীয়ত: স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে থাকে এবং তারা তাদের কাজের জন্য জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকে। অপরদিকে স্থানীয় সরকার সরকারী কর্মকর্তাদের দ্বারা পরিচালিত হয়ে থাকে। তারা সরাসরি সরকারের কাছে জবাবদিহি করে থাকে। 
..
তৃতীয়ত: স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার স্থানীয় এলাকার উন্নয়নের জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে পারে। কিন্তু স্থানীয় সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশ মোতাবেক নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালন করে মাত্র, স্থানীয়ভাবে পরিকল্পনা প্রণয়নের সুযোগ নেই। 
...
চতুর্থত: স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার করারোপের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে নিজস্ব তহবিল গঠন করতে পারে। সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। 
..
পঞ্চমত: স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের কর্মকান্ডে জনগণ অংশ গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু স্থানীয় সরকারের কর্মকান্ডে জনগণের অংশ গ্রহণের সুযোগ নেই। 
..
ষষ্ঠত: স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের মেয়াদকাল সীমিত, এর কর্মকর্তারা একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য নির্বাচিত হয়ে থাকেন, মেয়াদ শেষে এর পরিসমাপ্তি ঘটে । পক্ষান্তরে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান একটি স্থায়ী প্রতিষ্ঠান।
..
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, গঠন কাঠামো, আইনগত ভিত্তি, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের দিক থেকে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার ও স্থানীয় সরকারের মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান রয়েছে। 
..
৪. স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের গুরুত্ব
আধুনিক রাষ্ট্র আয়তন ও জনসংখ্যার দিক থেকে বিশাল। কেন্দ্রে বসে সরকারের পক্ষে সকল দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করা সম্ভব হয়না, সেই সাথে জনকল্যাণ মূলক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সরকারের দায়িত্ব ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলছে। এমতাবস্থায়, স্থানীয় সমস্যা সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য বিকেন্দ্রীকররণের মাধ্যমে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের উপর কেন্দ্রীয় সরকার নানাবিধ কাজের দায়িত্ব অর্পণ করে । তাই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের গুরুত্ব অনেক বেশী। এ ব্যবস্থায় জনগণ স্থানীয় পর্যায়ে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অংশ গ্রহণের মাধ্যমে নিজেদের দক্ষতা ও দায়িত্বশীলতা বৃদ্ধি করতে পারে। স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারকে গণতন্ত্রের সূতিকাগার বলা হয়ে থাকে কারণ এর মাধ্যমে জনগণ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ গ্রহণের বাস্তব শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে। বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, সচেতনতা সৃষ্টি, রাজনৈতিক অংশ গ্রহণ ও বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কর্মকান্ড পরিচালনায় স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের গুরুত্ব অপরিসীম।
..
৫. স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের বিবর্তন 
বাংলাদেশে বর্তমানে আমরা যে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের কাঠামো দেখতে পাই তা ঐতিহাসিক বিবর্তনের ফল। বাংলাদেশের স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের বিবর্তনকে-
..
ক. প্রাক-বৃটিশ বা মোঘল শাসন আমল, 
খ. উপনিবেশিক বা বৃটিশ শাসন আমল, 
গ. পাকিস্তান শাসন আমল এবং 
ঘ. বাংলাদেশ শাসন আমল 
এই চারটি পৃথক পর্বে ভাগ করা যায়।
..
ক. প্রাক-বৃটিশ বা মোঘল শাসন আমল 
প্রাক-বৃটিশ বা মোঘল শাসন আমলে গ্রাম পঞ্চায়েত, মহাল এবং পরগনা এই তিন স্তর বিশিষ্ট একধরণের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। এর মধ্যে বয়োজৈষ্ঠ গ্রাম প্রধানদের নেতৃত্বে গ্রাম পঞ্চায়েত গ্রামের শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখাসহ সামাজিক কিছু দায়িত্ব পালন করতো। জমিদারদের নেতৃত্বে মহাল জনসাধারণের কাছ থেকে কর আদায় করতো আর পরগনার দায়িত্ব ছিল সরকারের স্বাৰ্থ দেখাশুনা করা।
..
খ. বৃটিশ শাসন আমল 
লর্ড কর্ণওয়ালিশের পরিকল্পনা মোতাবেক ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আওতায় জমিদারি প্রথা প্রবর্তনের মাধ্যমে বৃটিশরা গ্রাম পর্যায়ে তাদের উপনিবেশিক শাসনের সম্প্রসারণ করে। এ ব্যবস্থায় রাজস্ব আদায়ের দায়দায়িত্ব জমিদারদের উপর অর্পণ করা হয় । ১৮৭০ সালে গ্রাম-চৌকিদারি আইনের আওতায় গ্রামাঞ্চলে চৌকিদারি পঞ্চায়েত গঠনের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার নতুন ধারার সূচনা করা হয়। তারপর বৃটিশরা তাদের প্রায় দুইশত বছরের শাসনামলে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার নানা পরীক্ষা-নিরিক্ষা করে। তারা গ্রাম পর্যায়ে পৌরসভা ও ছোট ছোট শহরে পৌর কমিটি গঠন করে । এই সকল প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য উপনিবেশিক সরকার ১৮৭০ সালে গ্রাম-চৌকিদারি আইন, ১৮৭১ সালের জেলা বোর্ড আইন, ১৮৮৫ সালের বেঙ্গল লোকাল সেলফ গভর্ণমেন্ট আ্যাক্ট, ১৯১৯ সালের বঙ্গীয় গ্রামীণ স্বায়ত্তশাসন আইন, ১৮৬৪ ও ১৮৬৮ সালের পৌরসভা আইন উল্লেখযোগ্য উল্লেখ্য ।
..
গ. পাকিস্তান শাসন আমল 
১৯৪৭-৫৮ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানে পূর্বের ন্যায় ইউনিয়ন বোর্ড, জেলা বোর্ড ও পৌরসভা বহাল থাকে। তবে এই সকল প্রতিষ্ঠানে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়। জেনারেল আইয়ুব খান ১৯৫৯ সালে ‘মৌলিক গণতন্ত্র আদেশ বলে পূর্বের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দিয়ে তদস্থলে ৫ স্তর বিশিষ্ট নতুন ধরনের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। স্তরগুলো নীচ থেকে উপরের দিকে যথাক্রমে ইউনিয়ন কাউন্সিল, থানা কাউন্সিল, জেলা কাউন্সিল, বিভাগীয় কাউন্সিল ও প্রাদেশিক কাউন্সিল বিন্যস্ত ছিল। এই পাঁচ স্তরের মধ্যে ইউনিয়ন কাউন্সিল ছিলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, গ্রাম উন্নোয়নে ইউনিয়ন কাউন্সিলকে পূর্বের ইউনিয়ন বোর্ডের তুলনায় অধিকতর ক্ষমতা প্রদান করা হয় এবং প্রয়োজনীয় অর্থ সরবরাহ করা হয়। মৌলিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানকে দুটি ইউনিটে বিভক্ত করে উভয় অঞ্চল থেকে ৪০,০০০ করে মোট ৮০,০০০ ইউনিয়ন কাউন্সিল সদস্যদের দ্বারা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, জাতীয় ও প্রাদেশিক সদস্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়। এই ব্যবস্থায় উপরের দিকে অর্থাৎ কেন্দ্রীয় পর্যায়ে স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা বহাল থাকলেও স্থানীয় পর্যায়ে প্রতিনিধিত্বশীল ব্যবস্থা প্রবর্তনের উদ্যোগ নেয়া হয় । মৌলিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হিসেবে পরিচিত এই ব্যবস্থা না ছিল মৌলিক না ছিল গণতান্ত্রিক, এর মূখ্য উদ্দেশ্য ছিল জনগণের সমর্থন আদায় করে সামরিক সরকারের অবৈধ ক্ষমতাকে বৈধ করা ।
..
ঘ. বাংলাদেশ আমল
স্বাধীনতার পর সংবিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত অন্তবর্তীকালীন ব্যবস্থাধীনে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহ পরিচালিত হতে থাকে। ১৯৭২ সালে প্রণীত নতুন সংবিধানে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়। ১৯৭৩ সালে রাষ্ট্রপতির বাংলাদেশ স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভা) আদেশ’ বলে এই দু’টি প্রতিষ্ঠানের কাঠামোগত পরিবর্তন আনয়নের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক রূপ প্রদান করা হয় । স্বাধীনতার পর থেকে অদ্যাবদি গণতান্ত্রিক ও সামরিক সরকারের শাসনামলে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের রূপ বা স্তর বিন্যাস নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয় । বর্তমানে ইউনিয়ন পরিষদকেই সবচেয়ে কার্যকর স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। এছাড়া শহরাঞ্চলে পৌরসভা ও ৬টি বিভাগীয় শহরে সিটি কর্পোরেশন এবং তিন পার্বত্য জেলায় (খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও রাঙ্গামাটি) স্থানীয় জেলা পরিষদ আছে, যা পার্বত্য জেলা পরিষদ নামে পরিচিত ।

Courtesy: Zakir's BCS Special

No comments:

Post a Comment

Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...